বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির তিন সপ্তাহ পর আবার দাম বাড়ানো হলো। এবার নির্বাহী আদেশে গ্রাহকের পাশাপাশি পাইকারি পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে ৫ শতাংশ এবং পাইকারি পর্যায়ে গড়ে ৮ শতাংশ বাড়িয়ে বিদ্যুতের নতুন মূল্যহার নির্ধারণ করেছে সরকার। এ দাম আজ বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) থেকে কার্যকর হবে।
এ নিয়ে এক মাসের মধ্যে নির্বাহী আদেশে দুইবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। একই সময় একবার বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম।
মূল্যবৃদ্ধির ফলে গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম দাঁড়াবে সাত টাকা ৮৫ পয়সা, যা আগে সাত টাকা ৪৮ পয়সা ছিল। গড়ে পাইকারি বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের দাম ছয় টাকা ২০ পয়সা থেকে বেড়ে হচ্ছে ছয় টাকা ৭০ পয়সা।
বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে গত সোমবার প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ বিভাগ। গতকাল মঙ্গলবার সকালে প্রজ্ঞাপনটি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত ১২ জানুয়ারি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, যা জানুয়ারি থেকে কার্যকর। অন্যদিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গত ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১৯.৯২ শতাংশ বাড়িয়েছিল, যা গত ডিসেম্বর থেকে কার্যকর। এদিকে গত ১৮ জানুয়ারিতে শিল্প, বাণিজ্যিক ও বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে সর্বোচ্চ ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিও আজ ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। গত তিন সপ্তাহে তিন দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘটনা ঘটল, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।
আগে কখনো এত কম সময়ের মধ্যে ঘন ঘন গ্যাস বা বিদ্যুতের দাম বাড়েনি। এটি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে চাপ বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রেকর্ড মূল্যস্ফীতির কারণে জীবন যাপনের ব্যয় নির্বাহে এমনিতেই দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ, তার ওপর এক মাসে দুই দফা গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এই চাপকে আরো দুর্বহ করে তুলবে। গ্যাস-বিদ্যুতের লাগাতার এ মূল্যবৃদ্ধিতে শিল্প-কারখানার উৎপাদনে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে। এতে আরেক দফা মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পাইকারি পর্যায়ে অধিক হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকারী কম্পানিগুলো আবার মূল্যবৃদ্ধির দাবি তুলতে পারে। খুচরায় দাম বাড়ানো হলে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরো বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকার বাজেট সহায়তা হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে। সেখানে আইএমএফ ভর্তুকি সংস্কারের জন্য বলেছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সরকার সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দেয়। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল বলেন, ‘প্রতিমাসেই আমরা বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করব। এতে দাম কমতেও পারে, বাড়তেও পারে। মূলত ফুয়েলের দামের ওপর ভিত্তি করে দাম সমন্বয় করা হবে। আমরা ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসব, এটাই মূল লক্ষ্য। এবার ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য পাইকারি পর্যায়ে ৮ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে।’
নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমরা যদি দেখি ফুয়েলের দাম স্থিতাবস্থায় এসেছে, তখন হয়তো আর সমন্বয় করতে হবে না। ফুয়েলের দাম যেভাবে বাড়ছে, দাম সমন্বয় আমাদের করতেই হবে। অন্য কোনো বিকল্প নেই।’
তিনি বলেন, ‘আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে পুরোপুরি ভর্তুকি থেকে আমরা বের হয়ে আসব। এ জন্য বলছি, আপনারা বিদ্যুৎ সাশ্রয় করুন, কম ব্যবহার করেন।’
অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজারে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় মানুষ চাপে আছে। এভাবে লাগাতার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাবে। যার ফলে মানুষের ওপর চাপ আরো বাড়বে।’ তিনি বলেন, ‘সমন্বয়ের নামে এভাবে যে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে, সমন্বয় করে তো আর কমানো হয় না।’
সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী লাইফ লাইন (৫০ ইউনিটের কম ব্যবহারকারী) গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির সময় ১৯ পয়সা বাড়িয়ে ৩.৯৪ টাকা করা হয়েছিল। এবার আরও ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৪.১৪ টাকা করা হয়েছে। প্রথম ধাপে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যমান দর ৪.৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪.৬২ টাকা, দ্বিতীয় ধাপে ৭৬-২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যমান দর ৬.১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬.৩১ টাকা, ২০১-৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যমান দর ৬.৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬.৬২ টাকা, ৩০১-৪০০ ইউনিটের বিদ্যমান দর ৬.৬৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬.৯৯ টাকা, ৪০১-৬০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যমান দর ১০.৪৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০.৯৬ টাকা, সর্বশেষ ধাপ ৬০০ ইউনিটের ঊর্ধ্বে ব্যবহারকারীদের বিদ্যমান দর ১২.০৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২.৬৩ টাকা করা হয়েছে।